আজ || রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫
শিরোনাম :
  গোপালপুরে এসএসসি পরীক্ষায় কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা       ধনবাড়ি মডেল প্রেসক্লাবে সাংবাদিক তুহিন হত্যার প্রতিবাদ ও দোয়া       গোপালপুরে মরহুম আরাফাত রহমান কোকো স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট       টাঙ্গাইল-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী শাকিল উজ্জামান       গোপালপুরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ       গোপালপুরে শিক্ষার্থীদের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করেন সালাম পিন্টু       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ছাত্রদলের বিক্ষোভ       গোপালপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় জুলাই শহীদ দিবস পালিত       গোপালপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল       গোপালপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় ১২ মামলার আসামি চাকমা জাহাঙ্গীর নিহত    
 


চা শ্রমিকদের হাল; বায়ান্ন বছর চা-বাগানে চাকরি শেষে করুণা রায়ের পেশা এখন ভিক্ষাবৃত্তি

Photo

– অধ্যাপক জয়নাল আবেদীন

বিধবা করুণা রায়। বয়স ৭৫। পরিচয় সাবেক চা শ্রমিক। ঠিকানা মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই চা-বাগানের লেবার কলোনি। স্বামী শান্তনু মারা যায় তেরো বছর আগে। তারও তিন বছর আগে কলেরা ও টাইফয়েডে গেছে দুই মেয়ে ললিতা ও নন্দিতা। পিতৃ ও স্বামীকূলে কেউ নেই। এজন্য দুর্দশার ও অন্ত নেই। একটানা ৫২ বছর ধলই চা বাগানে লেবারির পর ২০০১ সালে বাধ্যতামূলক অবসর। লেবারি না থাকায় শ্রমিক কলোনির (প্রচলিত শব্দ লেবার লাইন) বাসাও ছাড়তে হয়। চা শ্রমিকদের অবসর ভাতা নেই। তাই আশ্রয়চ্যুত করুণার অটুলি জোটে কলোনির আরেক লেবার সুনীল রায়ের গোশালার বারান্দায়। পেট চলে ভিক্ষার চালে। বয়সের ভারে ন্যুজ করুণা একহাতে ভিক্ষার থাল আর অন্য হাতে লাঠি ভর করে শ্রমিক কলোনিতে মাগন করে বেড়ায়। গরীব হলেও আত্মসন্মান বোধ টনটনে। জানায়,‘ভিক্কে করিনে বাবু। নগর করি খাই। পূর্বপুরছরা ছিল রায় বংছের। গরীবি হোলে ইংরেজরা ছাকরির কথা বলে গুজরাট থেকে বাংগালায় নিয়ে আছে। তখন থাকি কয়পুরুষ ধরি এখানি আটকি আছি।’ সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা শেড এর উদ্যোগে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার চা গবেষণা কেন্দ্রের হলরুমে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বল্প পরিচিত জাতি গোষ্ঠি এবং চা শ্রমিক’ এর উপর চার দিনব্যাপি অনুসন্ধান রির্পোটিং এ মাঠ গবেষণার সময় গত ২০ অক্টোবর ধলই চা বাগানে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে করুণার দেখা হয়। সেখানে ওইভাবে কথা বলছিলেন তিনি। করুণা আরো জানান, বাবা ভজহরি ছিলেন রাজনগর টি স্টেটের চা শ্রমিক। একমাত্র সন্তান করুণাকে নয় বছর বয়সে বিয়ে দেন তিনি। স্বামী কমলনগর উপজেলার ধলই চা বাগানের শ্রমিক শান্তনু। ভালোই ছিল সংসার। মেয়ে ললিতা ও নন্দিতাকে বিয়ে দেন মাধবনগর ও শমসের নগর টি স্টেটের শ্রমিক তন্নু শিং ও হরপ্রাণের সাথে। বিয়ের তিন বছর ললিতা কলেরায় আর পাঁচ বছর নন্দিতা টাইফয়েডে মারা যায়। এক পর্যায়ে শান্তনু বুক ব্যাথা নিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে করুণার নিঃসঙ্গ জীবনের শুরু। জানায়,‘ বাবু বায়ান্ন বচর খাটিছি বাগানে। কোনো পেনছন পাইনে। রেছন নাই। টেকা নাই। ওছুৎ কিনবার পয়ছা নাই। বাত বেতায় রাতভরি কোঁকাই। ঘুমাইবার না পারি। লেবার লাইনের মেম্বার ছাবরে কতবার কইছি বাপ নগর ঘুরবার নাগি অখন আর হাটবার পারি না। বয়স্ক ভাতার কাট দেও। কিন্তু মেম্বার উল্টো বলিছে, ‘তুমিতো অখন শশ্মান যাবে। কাট দিয়ি কি হবি ? বলেনতো এ কেমন কথা হলি? মললে কে আমায় চিতায় শোয়াইবে?’ ধলই চা বাগানের শ্রমিক কলোনি ঘুরে জানা গেল এখানে প্রায় তিন হাজার লোকের বাস। স্থায়ী শ্রমিক ৫৮২ জন। অস্থায়ী শ্রমিক তিন শতাধিক। অবশিষ্ট কর্মক্ষমরা বেকার। একজন শ্রমিক বাগানে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দৈনিক মজুরি পায় ৬৯ টাকা। দুই বছর আগেও ছিল ৩২ টাকা। সামান্য রেশন পায়। তবে রেশনের আটা নি¤œ মানের হওয়ায় মুখে তোলা যায়না। কলোনির অধিকাংশ ঘরবাড়ি ভাঙ্গাচোরা। বসবাসের অনুপযোগি। বাগান কর্তৃপক্ষ পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও শিক্ষা সরঞ্জাম নেই। ব্রাক পরিচালিত স্কুলটিতে বেশকিছু ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। বাজার লাইনের প্রবীণ চা শ্রমিক রণবীর আগরওয়াল জানান, কলোনির ৪/৫ মাইলের মধ্যে হাইস্কুল নেই। এজন্য চাশ্রমিকের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা নিতে পারেনা। তাছাড়া উচ্চশিক্ষা নিয়ে করবেই বা কি? কারণ চাকরির ক্ষেত্রে চাজনগোষ্ঠির জন্য কোনো কোঠা নেই। অথচ আমাদের পড়শি মনিপুরি সম্বপ্রদায়ের জন্য কোঠা রয়েছে। কলোনিতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় রয়েছে। সব রোগের জন্য একই ওষুধ। কম দামি এন্টিবায়োটিক আর প্যারাসিটামল। ধলই চা বাগানের পঞ্চায়েত প্রধান শ্রী নয়নশীল জানান, ভারতে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি প্রায় তিনশ টাকা। শ্রীলঙ্কায় আরো বেশি। বাংলাদেশের চায়ের বাজার দর উর্ধমুখি। তবে কেন আমরা ভালো মজুরি পাবোনা? সরকার চাশ্রমিকদের ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব সম্পূর্নরুপে বাগান মালিক বা কোম্পানির উপর ছেড়ে দিয়েছে। তারা শ্রমিকদের স্বার্থ দেখছেনা। শুধু নিজের লাভ বুঝে নিচ্ছে। ফলে চাশ্রমিকদের দুর্দশা ঘুচছেনা। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রামভজন কৈরি জানান, বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া বাগানে। সারাদেশে ১৬৩টি চা বাগান (নর্থ বেঙ্গল বাদে) রয়েছে। চা চাষ হয় ৫২ হাজার ৪০০ হেক্টরে। আভ্যন্তরীন চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় চায়ের দাম ও বেড়ে গেছে। মালিকরা ক্রমবর্ধহারে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু দুটি পাতা একটি কুড়ি তোলার কাজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীর্ণশীর্ন যে শ্রমিকরা অমানুষিক পরিশ্রম করেন তাদের ভাগ্যের নূণ্যতম পরিবর্তন হচ্ছেনা। সব চা বাগানের চিত্র কমবেশি একই রকম। তাদের বঞ্চনার খবর মিডিয়ায় খুব একটা আসেনা। কারণ ঢাকার মিডিয়া হাউজ মালিকদের অধিকাংশই চা চাষ অথবা এর বিপণনের সাথে পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তিনি আরো জানান, সরকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের নূণ্যতম মজুরি বেঁধে দেয়ার ক্ষেত্রে যতটা সিরিয়াস চা শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে ততটাই নার্ভাস। নইলে সংখ্যায় লক্ষ কোটা ছাড়িয়ে যাওয়া প্রান্তিক ও সুবিধা বঞ্চিত এ জনগোষ্ঠির ভালোমন্দ দেখার সব দায়িত্ব একতরফা ভাবে শুধু বাগান মালিককের উপর সরকার ছেড়ে দেয়ার মানসিকতা দেখাতে পারতোনা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের (শ্রীমঙ্গল) পরিচালক হারুন অর রশীদ জানান, চা শ্রমিকদের কিছু কিছু সমস্যা আছে। তবে সব মিলিয়ে সিলেটের চা শ্রমিকরা অনেকটা ভালো আছে।

মন্তব্য করুন -


Top
error: Content is protected !!